প্রধান অতিথি নোবেল লরিয়েট প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে গ্রামীণ আমেরিকা’র তৃতীয় বার্ষিক অংশীজন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো নিউ ইয়র্কে ।
ইউনূস সেন্টার প্রেস রিলিজ (০২ এপ্রিল, ২০২৩ )
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম ও দ্রুত বর্ধনশীল ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা “গ্রামীণ আমেরিকা”র তৃতীয় বার্ষিক অংশীজন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো নিউ ইয়র্কে। ২২ মার্চ ২০২৩ ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত এই সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও গ্রামীণ আমেরিকার কো-চেয়ার প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। গ্রামীণ আমেরিকার ৮০ জনেরও বেশী কমিউনিটি পার্টনার, বিনিয়োগকারী ও সমর্থক এই সম্মেলনে অংশ নেন। দেশটির দরিদ্র বিশেষত অশ্বেতকায় নারীদের ক্ষুদ্রঋণ ও অন্যান্য সেবার মাধ্যম উদ্যোক্তায় পরিণত করতে গ্রামীণ আমেরিকা এবং তার পার্টনার ও বিনিয়োগকারীরা একনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশের দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত গ্রামীণ নারীদের ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে উদ্যোক্তায় পরিণত করতে প্রফেসর ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর প্রবর্তিত এই ক্ষুদ্রঋণ মডেল পরবর্তীতে বিশ্বের শতাধিক দেশে দারিদ্র বিমোচনের কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে গৃহীত হয়। ২০০৮ সালে প্রফেসর ইউনূস তাঁর এই মডেল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রয়োগ করেন। একটি পরীক্ষিত দলগত ঋণদান পদ্ধতিকে কেন্দ্রে রেখে গ্রামীণ আমেরিকা ঋণ পুঁজি, ক্রেডিট ও অ্যাসেট বিল্ডিং, এবং ব্যবসা প্রশিক্ষণের একটি পদ্ধতি গড়ে তুলেছে যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অত্যন্ত কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠানটির জন্মলগ্ন থেকে গ্রামীণ আমেরিকা দেশটির ২৫টি শহরে ১৬৭,০০০ দরিদ্র নারীকে ৩০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশী ব্যবসায় পুঁজি সরবরাহ করে এই নারীদের সফল উদ্যোক্তায় পরিণত করেছে।
অংশীজন সম্মেলনের অন্যতম আকর্ষণ ছিল ক্ষুদ্রঋণের ভবিষ্যৎ এবং দরিদ্র নারী উদ্যোক্তাদের জন্য প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন নিয়ে প্রফেসর ইউনূস ও গ্রামীণ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রিয়া জাংয়ের মধ্যকার চিত্তাকর্ষক সংলাপ। অনুষ্ঠানে আরো ছিল ভবিষ্যতের বিভিন্ন কৌশলগত উদ্যোগ নিয়ে গ্রামীণ আমেরিকার নেতৃবৃন্দের সাথে প্যানেল আলোচনা।
অনুষ্ঠানের প্রধান প্রধান ঘোষণা ও অর্জনসমূহের অন্তর্ভূক্ত ছিল:
৩০০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ: ২০২৩ সালের শুরু পর্যন্ত গ্রামীণ আমেরিকা দরিদ্র অশ্বেতকায় নারীদের মধ্যে ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার ক্ষুদ্রঋণ হিসেবে বিতরণের মাইলফলক অতিক্রম করেছে - এর মধ্যে ২০১৮ সালের মধ্যে ১০০ কোটি ও ২০২১ সালের মধ্যে ২০০ কোটি ডলার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এই রেকর্ড অগ্রগতির মধ্য দিয়ে গ্রামীণ আমেরিকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে।
ভৌগোলিক সম্প্রসারণ: ২০২৩ সালে গ্রামীণ আমেরিকা ক্যালিফোর্নিয়ার রিভারসাইড, অ্যারিজোনার ফিনিক্স ও নিউ ইয়র্কের কুইন্সে তার কার্যক্রম সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করছে।
একটি ১০ বছরের সাহসী রূপকল্প: প্রতিষ্ঠানটি আগামী ১০ বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি শহরে ৫৮০,০০০ দরিদ্র নারী উদ্যোক্তাকে ২,০০০ কোটি ডলার ব্যবসায় পুঁজি ও অন্যান্য সেবা সরবরাহের পরিকল্পনা গ্রহণ করছে।
একটি পরীক্ষামূলক জাতীয় সঞ্চয় কর্মসূচি চালু : গ্রামীণ আমেরিকা দেশটির দরিদ্র নারী উদ্যোক্তাদের উপযোগী একটি উদ্ভাবনশীল সঞ্চয় কর্মসূচি পরীক্ষামূলকভাবে চালু করতে যাচ্ছে যা প্রতিষ্ঠানটির উপকারভোগীদের জন্য দীর্ঘমেয়াদে সম্পদ সৃষ্টি ও তাদের মধ্যে সঞ্চয়ের মনোভাব তৈরীতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
সদস্যদের জন্য নতুন মোবাইল ফোন অ্যাপ্লিকেশন: গ্রামীণ আমেরিকা তার সদস্যদের ঋণ সংক্রান্ত তথ্য, ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধ, প্রশিক্ষণ এবং বেশ কযেকটি শাখা অফিসের কাজকর্মের অটোমেশনের সুবিধার্থে একটি মোবাইল ফোন অ্যাপ্লিকেশন তৈরী করেছে। এতে সদস্যরা একদিকে যেমন তাঁদের সুবিধামত ঋণ গ্রহণ, পরিশোধ ও প্রশিক্ষণের সুবিধা নিতে পারবেন, অপরদিকে কর্মচারীরাও সদস্যদের সাথে আরো বেশী যোগাযোগ রক্ষা করতে সক্ষম হবেন।
কৃষ্ণবর্ণের নারী উদ্যোক্তাদের যুক্ত করা: ২০২২ সালে গ্রামীণ আমেরিকা আটলান্টায় “এলিভেট” নামে একটি নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করে যার মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে ঐ রাজ্যের ৮০,০০০ কৃষ্ণবর্ণ নারী উদ্যোক্তাকে ১৩০ কোটি ডলার ব্যবসায় পুঁজি সরবরাহ করা হবে।
উন্নত জীবনমান এবং বহনযোগ্য স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে উচ্চাভিলাসী পরিকল্পনা: এই পরিকল্পনার অধীনে ১৬ মিলিয়ন ডলারের “হেলদিয়ার টুগেদার ক্যাম্পেইন”-এর মাধ্যমে আগামী ৫ বছরে ১৫টি স্থানে ৪৭,০০০ দরিদ্র নারীকে সেবা প্রদান করা হবে।
অনুষ্ঠানে সম্প্রতি প্রকাশিতব্য ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন “উইমেন্স আর লিমিটলেস”-এর একটি প্রাক-অবলোকন করা হয় যেখানে ২০২২ সালের বিভিন্ন কর্মকান্ড, গ্রামীণ আমেরিকার ন্যাশনাল অ্যাম্বাসেডর জেনিফার লোপেজের একটি চিঠি, সদস্যদের বিভিন্ন কাহিনী, কর্মসূচির অগ্রগতি ও সর্বশেষ তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে।
গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও গ্রামীণ আমেরিকার কো-চেয়ার প্রফেসর ইউনূস বলেন, “২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত গ্রামীণ আমেরিকার অগ্রগতি এককথায় অবিশ্বাস্য। এখন থেকে ১৫ বছর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি চালু করা একরকম অসম্ভব একটি কাজ বলে মনে হয়েছিল। এই অসম্ভবকে সম্ভব করার জন্য গ্রামীণ আমেরিকাকে ধন্যবাদ। এই অসাধারণ অর্জনগুলির মধ্য দিয়ে নারীদের পক্ষে তাঁদের জীবন, তাঁদের সমাজ ও তাঁদের দেশকে রূপান্তরিত করার সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।”
গ্রামীণ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী অ্যান্ড্রিয়া জাং বলেন, “গ্রামীণ আমেরিকার লক্ষ্য হলো একটি অন্তর্ভূক্তিমূলক সমাজ সৃষ্টি যেখানে লিঙ্গ, বর্ণ ও আয় নির্বিশেষে সকল মানুষের ন্যায্য ও সামর্থ্য অনুযায়ী পুঁজিতে প্রবেশাধিকার থাকবে - এবং এটি প্রকৃতই একটি দলীয় কাজ। আমাদের অসামান্য পার্টনারদের সহযোগিতা ছাড়া আমাদের কার্যক্রম ও তার অভিঘাততে এই পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো না।”
গ্রামীণ আমেরিকার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
গ্রামীণ আমেরিকা নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস কর্তৃক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫০১ (সি)(৩) আইনে প্রতিষ্ঠিত একটি অলাভজনক ক্ষুদ্রঋণ সংগঠন যার লক্ষ্য যুক্তরাষ্ট্রের দরিদ্র মহিলাদেরকে পুঁজি সরবরাহ করে সফল ব্যবসা উদ্যোক্তায় পরিণত করা এবং এভাবে তাঁদের ও তাঁদের পরিবারের জন্য উন্নততর জীবনমান নিশ্চিত করা। প্রতিষ্ঠানটি দেশটির দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে দারিদ্রমুক্ত হতে এবং কমিউনিটির উন্নয়নে ক্ষুদ্রঋণ, প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সহায়তা দিয়ে থাকে। ২০০৮ সালে সংস্থাটির প্রতিষ্ঠার পর গ্রামীণ আমেরিকা এ পর্যন্ত ১ লক্ষ ৬৭ হাজারের বেশী নারী উদোক্তাকে ৩০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশী ঋণ প্রদান করছে। জ্যাকসন হাইট্স, কুইন্সে কার্যক্রম শুরু করার পর বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৫টি নগরীতে গ্রামীণ আমেরিকার কার্যক্রম বিস্তৃত। এগুলি হচ্ছে: আটলান্টা, জর্জিয়া; অস্টিন, টেক্সাস; বোস্টন, ম্যাসাচুসেট্স; ক্যামডেন, নিউ জার্সি; শার্লোট, নর্থ ক্যারোলাইনা; শিকাগো, ইলেনয়; কানেকটিকাট, ডালাস; ফ্রেসনো, ক্যালিফোর্নিয়া; হিউস্টন, টেক্সাস; ইন্ডিয়ানাপোলিস, ইন্ডিয়ানা; লস অ্যাঞ্জেলেস, ক্যালিফোর্নিয়া; মেমফিস, টেনেসি; মায়ামি, ফ্লোরিডা; নিউয়ার্ক, নিউ জার্সি; নিউ ইয়র্ক সিটি, নিউ ইয়র্ক; ওমাহা, নেব্রাসকা; ওকল্যান্ড, ক্যালিফোর্নিয়া; সান অ্যান্টোনিও, টেক্সাস; সান জোসে, ক্যালিফোর্নিয়া; ট্রেনটন, নিউ জার্সি; ও ইউনিয়ন সিটি, নিউ জার্সি।
সমাপ্ত