প্রফেসর ইউনূসের “A World of Three Zeros” গ্রন্থের চীনা সংস্করণ চালু
চীনের ৫টি নগরীতে সামাজিক ব্যবসা সপ্তাহ পালিত
প্রেস রিলিজ
নোবেল লরিয়েট প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সম্মানে জুলাই ১৯ থেকে ২৪ পর্যন্ত গ্রামীণ চায়নার আয়োজনে চীনে পালিত হলো “ইউনূস সামাজিক ব্যবসা সপ্তাহ।” চীনের কয়েকটি নগরীতে সপ্তাহ ব্যাপী এসব অনুষ্ঠানের বিভিন্ন সেশনে যোগ দেন চীনের গণ্যমান্য রাষ্ট্রীয় নেতা, ব্যবসায়ী নেতা, সামাজিক ব্যবসা পরিচালনাকারী, আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতের নেতা, ক্ষুদ্রঋণ কর্মী, ও ছাত্রগণ। ১৯ জুলাই প্রফেসর ইউনূস পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় ও হংকং পলিটেকনিক ইউনিভার্সিটির আয়োজনে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত “গ্লোবাল ইয়ুথ লীডার সামিট”-এ মূল সম্মেলন বক্তৃতা প্রদান করেন। বেইজিংয়ের নগর সরকারের সহযোগিতায় আয়োজিত এই সম্মেলনে ৫৬টি দেশ থেকে ১৫০ জন তরুণ নেতা অংশ নেন।
চীনের অন্যতম বৃহৎ স্টীল কোম্পানী শাওগাং গ্রুপের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত হয় এই সম্মেলন। শাওগাং কর্র্তৃপক্ষ প্রফেসর ইউনূসের সম্মানে একটি বিশেষ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে যেখানে শাওগাংয়ের মহাব্যবস্থাপক জনাব ঝ্যাং গংইয়ানসহ কোম্পানীর সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্বাহীরা যোগ দেন। প্রফেসর ইউনূসকে আরো সংবর্ধনা জানান বেইজিং মিউনিসিপাল পার্টি কমিটির সাংগঠনিক বিভাগের উপ-পরিচালক জনাব ওয়াং জিয়ানঝং যিনি পার্টি কমিটির পক্ষ থেকে প্রফেসর ইউনূসকে উপহার প্রদান করেন।
এরপর প্রফেসর ইউনূস পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে গমন করেন যেখানে তিনি পিকেইউ পলি-ইউ সোশ্যাল ওয়ার্ক রিসার্চ সেন্টার (PKU PolyU Social Work Research Centre) আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেন। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ১০ বছর পূর্বে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় প্রফেসর ইউনূসকে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে নিয়োগ দেয়।
তাঁর সফরকালে প্রফেসর ইউনূস দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক “পিপল্স ব্যাংক অব চায়না”র ঊর্ধ্বতন নির্বাহীদের সাথে বৈঠক করেন। পিপল্স ব্যাংক অব চায়না চীনের আর্থিক নীতি নির্ধারণসহ ও দেশটির আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে। বৈঠকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তারা চীনে সামাজিক ব্যবসা চালু ও দেশব্যাপী ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির প্রসারে আগ্রহ প্রকাশ করেন। এছাড়াও প্রফেসর ইউনূস চীন সরকারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ও বিশ্বব্যাপী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বেসরকারী সংস্থা “এশিয়ান ফাইনান্সিয়াল কো-অপারেশন অ্যাসোসিয়েশান”-এর আমন্ত্রণে সংস্থাটির সদর দপ্তর পরিদর্শন করেন। তাঁকে অভ্যর্থনা জানান সংস্থাটির সেক্রেটারী জেনারেল জনাব ইয়াং জাইপিং যিনি সংস্থার কর্মকান্ড সম্পর্কে প্রফেসর ইউনূসকে অবহিত করেন। তিনি প্রফেসর ইউনূসকে সংস্থাটির আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা কমিটির সদস্য হতে আমন্ত্রণ জানান।
প্রফেসর ইউনূস চায়না অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স আয়োজিত “বেইজিং ইনক্লুসিভ ফাইনান্স ফোরাম”-এ মূল ভাষণ প্রদান করেন। দুই শতাধিক অংশগ্রহণকারী এই ফোরামে যোগ দেন। তাঁর বক্তৃতায় তিনি সম্পদ কেন্দ্রীকরণ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে আরো বেশী সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল অর্থায়নকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠায় আর্থিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসতে দেশটির নেতৃস্থানীয় ব্যাংকার ও উদ্যোক্তাদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি চায়না কনস্ট্রাকশন ব্যাংকের সদর দপ্তরে ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের সাথে মধ্যাহ্ণভোজে অংশ নেন। ব্যাংকের চেয়ারম্যান প্রফেসর ইউনূসকে চীনে সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠা ও গ্রামীণ ক্ষুদ্রঋণ চালু করতে সহায়তা করার জন্য একটি জয়েন্ট ভেঞ্চার গঠনের আমন্ত্রণ জানান।
চায়না কনস্ট্রাকশন ব্যাংক চীনের বৃহত্তম চারটি ব্যাংকের (বিগ ফোর) একটি। পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম এই ব্যাংকটির কার্যক্রম নিউ ইয়র্ক, সিঙ্গাপুর, মেলবোর্ণ, ফ্রাঙ্কফুর্ট ও জোহানেসবার্গসহ বিশ্বের বহু নগরীতে বিস্তৃত।
২২ জুলাই প্রফেসর ইউনূস লুওয়ং পরিদর্শন করেন। চৈনিক সা¤্রাজ্যের এই প্রাচীন রাজধানীটি এখন একটি ব্যস্ত আধুনিক নগরী। লুওয়ং চৈনিক সা¤্রাজ্যের চারটি প্রাচীন বৃহৎ রাজধানীর একটি যেখান থেকে কয়েকটি রাজবংশ চীন শাসন করেছে। নগরীর মেয়র লিউ ওয়ান কাং ডেপুটি মেয়র ও নগরীর অন্যান্য উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তাদের নিয়ে প্রফেসর ইউনূসকে স্বাগত জানান। এছাড়াও প্রফেসর ইউনূস গ্রামীণ চায়না লুওয়ং শাখার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেন যেখানে গ্রামীণের বিশেষজ্ঞরা গ্রামীণ ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম প্রতিষ্ঠায় সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি লুওয়ং রয়্যাল মুডু হোটেলে লুওয়ং রুরাল কমার্শিয়াল ব্যাংক ও গ্রামীণ চায়নার মধ্যকার সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে সমবেত ৩০০ অভ্যাগতের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দেন। গ্রামীণ মডেল ব্যবহার করে দারিদ্র বিমোচন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়ন নিশ্চিত করতে প্রতিষ্ঠান দু’টি একযোগে কাজ করবে।
লুওয়ং থেকে প্রফেসর ইউনূস হেনান প্রদেশের রাজধানী জিয়াংজৌ গমন করেন যা চৈনিক সভ্যতার জন্মভূমি হিসেবে সুপরিচিত।
প্রফেসর ইউনূস জিয়াংজৌ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়টির সাথে একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেন। এটি চীনে প্রতিষ্ঠিত ৪র্থ ও পৃথিবীর ২৮টি দেশে প্রতিষ্ঠিত ৫৭তম ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার। হেনান প্রদেশে অবস্থিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে ৫৫,০০০ ¯স্নাতক পর্যায়ের ছাত্র, ১৫,০০০ পূর্ণকালীন স্নাZকোত্তর পর্যায়ের ছাত্র এবং ১১৬টি দেশের প্রায় ১,৮০০ আন্তর্জাতিক ছাত্র অধ্যয়ন করছে। নবপ্রতিষ্ঠিত এই ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস সেন্টারটির মাধ্যমে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক ও গবেষকগণ সমাজের জরুরী সমস্যাগুলো সমাধানের উদ্দেশ্যে সামাজিক ব্যবসার উপর গবেষণা, শিক্ষাদান, প্রায়োগিক গবেষণা, কর্মশালা ও অন্যান্য কর্মকান্ড পরিচালনার সুযোগ পাবেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শতাধিক শিক্ষক ও ছাত্রদের অংশগ্রহণে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে প্রফেসর ইউনূসকে জিয়াংজৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক অধ্যাপকের পদ প্রদান করা হয়।
প্রফেসর ইউনূস এরপর চায়না কনস্ট্রাকশন ব্যাংকের সাথে যৌথভাবে আয়োজিত “শেনচেন ইনক্লুসিভ ফাইনান্স ল্যাব”-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেন। এছাড়াও তিনি গুয়ানডং প্রদেশে অবস্থিত চীনের অন্যতম এই শহরটির ঊর্ধ্বতন সরকারী কর্মকর্তাদের সাথে একাধিক বৈঠক করেন যেখানে তিনি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কর্মপন্থার পরিবর্তে সামাজিক ব্যবসার অধীনে সমাজ-মুখী বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে প্রদেশটির উন্নয়নের উপায় বিষয়ে তাঁর চিন্তা-ভাবনা তাঁদের সাথে বিনিময় করেন।
চীনে সামাজিক ব্যবসা সপ্তাহের শেষদিকে প্রফেসর ইউনূস ২৩ জুলাই চাইনিজ ইউনিভার্সিটি অব হংকংয়ে আগমন করেন। উল্লেখ্য যে, গত বছর এই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রফেসর ইউনূস বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে সম্পদ কেন্দ্রীকরণের ঝুঁকি ও আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্সের বিপদ সম্পর্কে বক্তৃতা দেন।
তাঁর সপ্তাহব্যাপী চীন সফরে প্রফেসর ইউনূস চীনের ৫টি শহর পরিভ্রমণ করেন - বেইজিং, লুওয়ং, জিয়াংজৌ, শেনচেন ও হংকং। তাঁর সফরকালে তিনি তাঁর নতুন গ্রন্থ “A World of Three Zeros”-এর চীনা সংস্করণ উদ্বোধন করেন।
ছবির ক্যাপশন-১: চৈনিক সাম্ম্রা্রাজ্যের প্রাচীনতম চারটি রাজধানীর একটি এবং চৈনিক সভ্যতার অন্যতম সূতিকাগার লুওয়ং নগরীতে গ্রামীণ চায়নার শাখা উদ্বোধনকালে নগরীর মেয়র লিউ ওয়ান কাং এর সাথে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস।
ছবির ক্যাপশন-২: চীনে “ইউনূস সামাজিক ব্যবসা সপ্তাহ” চলাকালে বিমানবন্দরে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে স্বাগত জানাচ্ছেন গ্রামীণ চায়নার শেনচেন শাখার ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির উপকারভোগীগণ।