Yunus Centre GM for Social Fiction to keep Social Values intact
আমীর খসরু
আমাদের সামাজিক ব্যবস্থায় এখন আর পারিবারিক বন্ধন দেখা যায় না। যেমনটি দেখেছি সেই ছোট্ট বেলায়! কী যে মজা ছিল আগে! অল্পতেই মানুষ তার তৃপ্তি বা সুখ খুঁজে পেত। পারিবারিক বা সামাজিকভাবে একে অপরের সাথে মিলেমিশে থাকার মধ্যে অনেক আনন্দ থাকে। আধুনিক সভ্যতার জোয়ারে সেই সামাজিক বা পারিবারিক বন্ধনের মৃত্যু ঘটেছে। তাই, মানুষের মাঝে তৈরি হয়েছে স্বার্থপরতা। আর এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমান সমাজে বসবাসরত মানুষগুলোর মাঝে কোনো মানবিক গুণাবলির নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায় না। কালের বিবর্তনে, হাজার বছর ধরে বাংলার ঐতিহ্যকে ঘিরে যে কৃষ্টি ও সংস্কৃতি বলয়ের প্রাচীর গড়ে উঠেছিল এখন তা ভেঙে পড়েছে।
একটি শিশুর জন্য পারিবারিক বা সামাজিক শিক্ষাটাই হলো তার শিক্ষার প্রাথমিক ধাপ। আর এই শিক্ষাকেই তাকে ধারণ করে ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য প্রস্তুতি নিতে হয়। পরবর্তীতে শিক্ষার সঠিক নির্দেশনার মাধ্যমে তার সামাজিক দায়িত্ব পালন, তার ব্যবহার বা আচরণ, ভদ্রতা ইত্যাদির যে মৌলিক গুণাবলি থাকে তার সবকিছুই শিক্ষা পেয়ে থাকে। অথচ, ব্যক্তিগত সুখ বা শুধু নিজের স্বার্থের জন্য আমরা আমাদেরই ধ্বংস করে চলেছি। এখন পারিবারিক বা সামাজিক বন্ধন কোথাও দেখা যায় না। আমরা সবাই কেমন যেন স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছি। আমাদের চিন্তাশক্তির গভীরতা কেন যেন আমাদের নিয়েই শুধু ভাবায়। আমরা আমাদের ব্যক্তিগত সুখের জন্যই ব্যস্ত থাকি। আবার অন্যকে ঠকিয়ে আরও বেশি সুখের কথা ভাবতে থাকি। আর এই ব্যক্তিগত সুখের জন্যই আমরা আমাদের পরিবার বা সন্তানদের প্রতি কোনো দৃষ্টি দিতে পারি না। আর এই প্রতিযোগিতায় শুধু অর্থের পেছনে দৌড়াতে গিয়ে ছেলেমেয়েদের দেখভাল করা হয় না। অথচ সারাটি জীবন শুধু অর্থের পেছনে দৌড়াতে গিয়ে কী পেলাম?
এই সমাজে দেখা যায় পিতা তার শেষ জীবনে এসে অনুভব করতে পারে, অর্থ আর প্রাচুর্য জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হতে পারে না। কারণ, যে সুখের জন্য তাকে সারাটি জীবন শুধু স্বার্থপর হয়ে অর্থের পাহাড় গড়তে হলো, তারাই যে এখন চার দেয়ালের মাঝে মিছে স্বপ্ন দেখে আর উচ্ছিষ্টের যন্ত্রণার ডাস্টবিনে সেই অর্থ দিয়ে দিন কাটায়।
কেন এমন হলো? সময়ই কী হত্যা করেছে আমাদের? শুধু টাকার মোহে স্বার্থপর হয়ে পারিবারিক বন্ধন বা সামাজিক সহমর্মিতার সংস্পর্শ থেকে সে নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছি। ফলে সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। আর এরই দোলা লেগেছে পারিবারিক জীবনেও। শুধু ব্যক্তিগত বা পারিবারিক আর্থিক সুবিধার জন্য অনেকেই পরিবারের দিকে দৃষ্টি দেয় না। ফলে এখনকার ছেলেমেয়েরা বিপথগামী হয়ে অন্ধকার গলিতে ঢুকে পড়ছে। তাই গুলশান ঘটনার মতো বিভিন্ন অপরাধে আজ ধনী আর গরিব পরিবারের ছেলেমেয়েরা জড়িয়ে পড়ছে। এই বাচ্চা ছেলেগুলোর একটি সুন্দর দেশ, একটি সুন্দর জাতিকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে একটুও কষ্ট হয়নি। আর এই দেশের যে অপূরণীয় ক্ষতি হলো তা শুধরে উঠতে কয়েক যুগ লেগে যাবে। শুধু সমাজ বা পরিবার নয়, জাতির জন্য একটি কলঙ্ক ইতিহাস রচনা হলো। আর এই জন্য দায়ী তাদের পারিবারিক শিক্ষা, আর দায়ী থাকে স্বার্থপর হয়ে শুধু অর্থের প্রতিযোগিতায় পরিবারকে সকল সামাজিক আর পারিবারিক বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা। অথচ যে বাংলায় আমি জন্মেছি, যে ভাষায় আমি কথা বলতে শিখেছি, যে মাটির গন্ধ আমার রক্তে মিশে আছে, এই সবই আমরা ভুলতে বসেছি।
আবার, এমন এক সময় আমাদের সমাজে দেখেছি, তখন পড়াশোনা নিয়ে বাড়িতে বাড়িতে এক ধরনের প্রতিযোগিতা চলত। এলাকার বাসিন্দারা একে অপরের জন্য নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে আসত। অর্থের কোনো প্রতিযোগিতা ছিল না , ছিল শুধু পারিবারিক ঐতিহ্যকে ধরে রাখার প্রতিযোগিতা আর সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া। ধনী-গরিবেরা একে অপরের সাথে মিলেমিশে বসবাস করতে ভালোবাসত। অথচ, আজকের সমাজ ব্যবস্থায় আমরা দেখি, ভিন্ন দৃশ্য যেখানে শুধু অর্থের প্রতিযোগিতায় নিজেকে পরিচিত করতে ভালোবাসে সেটা পারিবারিকভাবে হোক বা সামাজিকভাবেই হোক না কেন। এই ধারাতেই বর্তমান আমরা সবাই চলছি। আর স্বার্থপরভাবে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য আমাদের চিন্তাশক্তির যে সেলুলয়েড ফিতা থাকে তাও একটি সময় হারিয়ে যেতে বসেছে।
পৃথিবীতে যে শিশুটি আগমন করে থাকে সে তার পিতা-মাতা বা পরিবারের জন্য একটি সুন্দর আগমন বার্তা নিয়ে পৃথিবীর আলো দেখতে দেখতে একটি সময়ে বড় হতে থাকে। আবার, বড় হয়ে সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব তাকে কাঁধে নিতে হয়। এই ধারাতেই বাঙালি জাতি তার জীবনের তৃপ্তির সুখ খুঁজে পায়।
পরিতাপের বিষয় , আমাদের সমাজব্যবস্থায় এখন আমরা সবাই কেমন যেন আমাদেরকে এই সবকিছু থেকে আলাদা করে ফেলেছি। আমরা সবাই কেন যেন স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছি। কেন যেন আমরা আমাদের ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য নিজেকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখি। পারিবারিকভাবে বা সামাজিকভাবেই হোক আমরা এই স্বার্থপর ধারাকে বেছে নিয়েছি। এভাবেই আমাদের সমাজব্যবস্থা চলছে। এভাবে কী আমাদের কাম্য ছিল? স্বার্থপরভাবে বসবাস করার জন্যই কী আমাদের সমাজব্যবস্থার বলয় তৈরি করা হয়েছিল? এর জন্য দায়ী কারা? তাহলে কী, আমাদের রাষ্ট্রের নীতি প্রণয়নকারী বা নীতি প্রণেতারাই এর জন্য দায়ী না, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাই শুধু দায়ী।
একটি শিশুকে পাঠ্য পুস্তক হাতে দিয়েই শেখানো হয়, ভালোভাবে পড়াশোনা করলে তুমি বড় হয়ে অনেক ভালো চাকরি পাবে , অনেক টাকা আয় করবে ইত্যাদি। জীবনের শুরুতেই শিশুটিকে একটি ভুল নির্দেশনা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হলো। আর সেই থেকে শুরু হলো বা সে জেনে গেল তার জীবনের মূল উদ্দেশ্য কী হতে পারে? আর ভালো চাকরির আশায় সে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে থাকে। আবার এ রকম ঘটে থাকে, দেখা যাবে চাকরির প্রতিযোগিতায় সে টিকতে পারেনি,আর তখনই তার জীবনে নেমে আসে হতাশা! আর এই হতাশার আগুনে ধুঁকে ধুঁকে একটি সময়ে চার দেয়ালের মাঝে তার জীবনের অর্থ প্রশ্নবোধক হয়ে দাঁড়ায়? ফলে, একটি সময় তার পারিবারিক বা সামাজিক জীবনে নেমে আসে অশান্তি। এভাবে ব্যর্থ হয়ে তার জীবনের প্রতি কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না ফলে দেখা যাবে, কোনো এক সময়ে সে পরিচিত কোলাহল থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখে। আর এই ধরনের পরিস্থিতিতে তার অনুভূতির তানপুরাতে রক্ত ক্ষরণ শুরু হতে থাকে। তার এই একাকিত্বের সুযোগে বিভিন্ন যোগসূত্রের মাধ্যমে একটি সময়ে অপরাধ জগতের পরিচয় হয়। সময় এসেছে, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এখনই এই বিপথগামী পথ থেকে সব তরুণদের স্বাভাবিক জীবনের জন্য পরিবার বা রাষ্ট্রের পাশাপাশি আমাদের সবাইকে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। অন্যথায়, আমাদের পারিবারিক অশান্তির পাশাপাশি সামাজিক বিশৃঙ্খলা বাড়তে থাকবে। আর একটি সময়ে এর প্রভাবে রাষ্ট্রে বসবাসরত সব মানুষের ওপর পড়বে। আবার, এ রকমও দেখা যায়, পড়াশোনা শেষে চাকরিতে যোগদানের পরবর্তীতে সামাজিক বা পারিবারিক যোগাযোগ থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখে। কারণ, পাঠদানের শুরুতেই ভুল নির্দেশনা শিখে সে এখন জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে ভুল করতে থাকে।
মানুষের জীবন কী শুধু অর্থের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে? এই সামান্য চাওয়াই কী মানুষের মুখ্য উদ্দেশ্য হতে পারে? আমাদের সমাজব্যবস্থা বা সমাজে বসবাসরত মানুষগুলো শুধু কী ব্যক্তি স্বার্থের জন্যই তার জীবনের তৃপ্তি খুঁজে পাই? সমাজব্যবস্থা বা সামাজিকভাবে মানুষ কী কখনো এভাবে স্বার্থপর জীবন কামনা করে? সামাজিক যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রয়েছে সেখানে সব মানুষের জন্য মৌলিক চাহিদার প্রয়োজনীয় সব উপকরণ এবং নিরাপদ জীবনের জন্য পারস্পরিক সহযোগিতার নির্দেশনা রয়েছে। পৃথিবীতে মানুষ অসম্ভব শক্তি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। মানুষ সৃজনশীল, বিশ্বাস করে। মানুষ সমাজে বসবাসরত সকলের জন্য সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষের মাঝে সৃজনশীল চিন্তার যে চেতনা শক্তি থাকে তার সবকিছুই নিঃস্বার্থভাবে সমাজে বসবাসরত মানুষদের মাঝে বিলিয়ে দিতে এগিয়ে আসে।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় যদি তুলে ধরা হয়, পৃথিবীতে তোমার জন্য দুই ধরনের নির্দেশনা দেওয়া আছে :
প্রথম গন্তব্যটি হলো :
‘শুধু আমার ব্যক্তিগত সুখের জন্য আমি শুধু আমার জন্য অর্থ উপার্জন করব।’
দ্বিতীয় গন্তব্যটি হলো :
‘শুধু অপরকে সুখী বা ভালো রাখা এবং আমার সামাজিক কাজের অংশ বিশেষ শুধু সামাজে বসবাসরত মানুষগুলো যারা বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে দিনযাপন করছে আমি শুধু তাদেরই সমস্যাকে সমাধানের জন্য অর্থ উপার্জন করব।’
এই দুই ধরনের নির্দেশনা থেকে একজন শিক্ষার্থী তার জীবনের শুরুতেই যেকোনো একটাকে বেছে নিয়ে তার জীবনকে সুন্দরভাবে ড্রাইভ করার জন্য প্রস্তুতি নিতে পারত। আর এ ধারাতে, শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা হলে, সামাজিকভাবে মানুষ মানুষের জন্য এগিয়ে আসতে পারত এবং সামাজিকভাবে বসবাসের জন্য একটি নিরাপদ ও সুন্দর পৃথিবীতে সবাই একটি বলয়ে বসবাস করতে পারবে।
তাই প্রয়োজন পড়েছে, এখনই প্রতিটি রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হবে এবং শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। পাশাপাশি, সামাজিক কাজের জন্য মেধা বিকাশের ক্ষেত্র তৈরি করতে পারলেই, আমরা আমাদের সামাজিক অবক্ষয় থেকে মুক্তি পেতে পারব। পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকেই এখনো আমরা সবাই একটি ভুল পথেই চলছি তো চলছি, যে পথের নির্দেশনায় আমরাই শুধু আমাদের স্বার্থপর করতে শিখেছি বা শিক্ষা গ্রহণ করছি।
এখনো সময় আছে, শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে পারলে আমরাই একটি সুন্দর পৃথিবী আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রেখে যেতে পারব। তাই অর্থের মোহে শুধু নিজেকে না জড়িয়ে মানুষের জন্য সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে সমাজে বসবাসরত মানুষদের নিয়ে সোশ্যাল ফিকশন তৈরি করতে পারলেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিরাপদ ও শান্তিতে বসবাসের জন্য একটি সুন্দর পৃথিবী উপহার দেওয়া সম্ভব হবে!
[লেখক : মহাব্যবস্থাপক, ইউনূস সেন্টার, ঢাকা, amir.khashru@yunuscentre.org]
Source: thereport24.com
Updated Date: 8th March, 2017