আমরা কেন শান্তির নোবেল পেলাম না

একটি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার মধ্যে যে মর্যাদা, সেটি এখনো অম্লান রয়েছে। সমালোচনা করলেও অনেকেই এর কাঙাল। আমরাও মুখিয়ে থাকি। তার প্রমাণ মিলল ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস নোবেল পাওয়ার পর। অনেকেই বললেন, এটি তার প্রাপ্য ছিল না। কারো কারো চোখ এতটা টাটালো, দেখতে ভালো লাগেনি। শুনতে বেখাপ্পা লেগেছে। অন্যের প্রাপ্তিতে নিজেও পাওয়ার ইচ্ছা জাগা মন্দ নয়। তবে ঈর্ষাকাতর হওয়ার মধ্যে মনে ঔদার্যের অভাব প্রমাণিত হয়। এবার শান্তির জন্য নোবেল গেল কলম্বিয়ায়। ফার্ক গেরিলাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ান ম্যানুয়াল সান্তোস নোবেল জয় করে নিলেন। এই শান্তিচুক্তির কারণে ৫২ বছরের একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবসান হলো। প্রেসিডেন্ট হুয়ান চুক্তিটি তার দেশে গণভোটে পাস করাতে পারেননি। কিন্তু শান্তিচুক্তির সুফল ল্যাটিন আমেরিকার দেশটিকে শান্তি ও স্থিতি দিয়েছে। জনগণ মনে করেছে, শান্তিচুক্তিতে বিদ্রোহীদের বেশি ছাড় দেয়া হয়েছে। তাই গণভোটে সম্মতি মেলেনি। এর পরও প্রেসিডেন্ট শান্তি ও স্থিতির পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন। নোবেল প্রাইজ সিলেকশন কমিটি তার এ অবস্থানটি মূল্যায়ন করেছে। তা ছাড়া, কলম্বিয়ায় তার ভাবমর্যাদা পুরোটাই ইতিবাচক। তার জনপদ রাজনৈতিক কারণে রক্তাক্ত নয়। তার কাছে কারো রক্তঋণ পাওনা নেই। শাসক হিসেবে সাফল্য-ব্যর্থতা আলাদা বিষয়।
শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বাংলাদেশও পেতে পারত। কারণ জনমত উপেক্ষিত হলেও বেশি ছাড় দিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী চুক্তির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। সংবিধান-বিচ্যুতির অভিযোগ উঠেছে। পাহাড়িদের বেশি সুবিধা পাইয়ে দিতে বাঙালিদের বঞ্চিত করার দাবি এখনো রয়েছে। সেখানকার ভূমি আইনের প্রতিবাদ হচ্ছে। ডক্টর ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক শান্তিতে যৌথভাবে নোবেল পাওয়ার পর বিতর্ক উঠেছিল, কেন শেখ হাসিনা ও সন্তু লারমাকে বঞ্চিত করা হলো? এখনো প্রশ্ন ওঠে, তাহলে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করা হলো না তো! নোবেল শান্তি পুরস্কার কখনো বিতর্কের ঊর্ধ্বে ওঠে না। আন্তর্জাতিকভাবে প্রভাবক দেশগুলোর নীতিনির্ধারকদের একটা ভূমিকা সব সময় এই পুরস্কারটির ব্যাপারে থাকে। তাই নোবেল পুরস্কার অন্যান্য ক্ষেত্রে যতটা গ্রহণযোগ্য হয়- শান্তির জন্য দেয়া পুরস্কারটি ততটাই বিতর্কিত হতে দেখা যায়। এ ছাড়া, এই পুরস্কারের সাথে আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটি গন্ধ স্পষ্ট। পরাশক্তির একটা ইচ্ছার প্রতিফলনও রয়েছে, যা বাংলাদেশের সরকারপ্রধান কখনো বিবেচনায় নিতে চাননি। এটা তার দোষ কি গুণ- সেটা আলাদা মূল্যায়নের বিষয়।
বিশ্বসম্প্রদায় এখনো মনে করে, কলম্বিয়ায় আইনের শাসন আছে। বিচার বিভাগের ভাবমর্যাদা অক্ষুণ্ন রয়েছে। গণতন্ত্রের চাষবাস ভালো, যা বাংলাদেশে নেই বলে মনে করা হচ্ছে। তা ছাড়া, কলম্বিয়ার অর্থনীতি স্থিতিশীল। পররাষ্ট্রনীতি জনগণের দৃষ্টিতে ভারসাম্যপূর্ণ। জনগণের সামগ্রিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা রয়েছে। মৌলিক ও নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্নের নজির কম। শাসকদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠেনি। কলম্বিয়ার রাজনীতিতে ভিন্ন মত ও প্রতিপক্ষের সহাবস্থান রয়েছে। নিজস্ব মতামত ও রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে কেউ নিপীড়িত হন না। রাজনৈতিক দমন-পীড়ন এবং হামলা-মামলার উপমা প্রায় চোখে পড়ে না। গুম-অপহরণ, ক্রসফায়ার ও নানা নামে বিচারবহির্ভূত হত্যার দৃষ্টান্ত একেবারে বিরল। নির্বাচনব্যবস্থা, সংসদ ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো যার যার কক্ষপথে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ এবং জনগণের কাছে আস্থাভাজন। কলম্বিয়ার সরকার এগুলো নিয়ন্ত্রণ করে, এমন অভিযোগ ওঠেনি।
অপর দিকে, বাংলাদেশের অবস্থা সম্পূর্ণ বিপরীত। আমরা শুধু বিশ্ব জনমত উপেক্ষা করে ফাঁসি কার্যকর করি না, নিরাপত্তা ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে শাহবাগে ‘মজমা’ বসিয়ে ‘ফাঁসি চাই ফাঁসি চাই’ স্লোগান তুলি। বিচার বিভাগের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে আইন পাল্টাই। রায়কে প্রভাবিত করি। বিচারবহির্ভূত হত্যাকে বৈধ করে নিতে অবিশ্বাস্য গল্প রচনা করি। গুমের এক আজব দেশের ‘স্বর্গরাজ্য’ বানিয়ে রাজনীতির বগল বাজাই। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করি। বিভিন্ন রাষ্ট্রের অনুরোধ করি উপেক্ষা। আবার সেটাকে রাজনৈতিকভাবে শক্ত মেরুদণ্ডের প্রমাণ ও সাহস বলে শ্লাঘাও বোধ করি।
৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন বিশ্বসম্প্রদায় বলছে, কোনো দেশে গ্রহণযোগ্য নয়- আমরা ভ্রুক্ষেপ করি না, জবরদস্তির সরকার গঠন করি। আমরা সংসদে ডামি বিরোধী দল ও নেত্রী বসাই। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও ভিন্ন মত পদদলিত করি। দেশের স্বার্থে কূটনৈতিক শিষ্টাচারকেও আমলে নিই না। স্বাধীন কিন্তু দূরদর্শী পররাষ্ট্রনীতিকে আমরা তোয়াক্কা করি না। যে নির্বাচন ভারত ছাড়া আর কেউ সমর্থন করেনি, সেই প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনকে বৈধতা দেয়ার ভান আমরা এখনো প্রদর্শন করে চলেছি। সব ক’টি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান আড়ষ্ট কিংবা অনুগত হয়ে আছে, সেটা অস্বীকার করি। কিন্তু প্রমাণ করতে পারি না। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর এমন কিছু গুণ আছে- যা অনেক নেতার মধ্যে থাকে না। বলা চলে, তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে কোলে-কাঁখে করে আজকের পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন। দলের লাখো জনশক্তিকে ক্ষমতার স্বাদ পাইয়ে দিয়েছেন। চিহ্নিত বাম রাজনীতিবিদদের ক্ষমতার ভাগ দিয়েছেন। বাম ঘরানার বুদ্ধিজীবীদের অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কাজে লাগিয়েছেন। অর্থাৎ, সক্ষমতা প্রদর্শনের ব্যাপারে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর জুড়ি কমই পাওয়া যাবে। তার সরকারের অনেক সাফল্য। কিন্তু প্রতিটি সাফল্য চাপা পড়ে যায় আরেকটি নেতিবাচক রাজনৈতিক ভুল কিংবা বাড়াবাড়ির কারণে। তাই ইতিবাচক সূচকে আমরা যে ক’বিঘত এগোতে পারি, ভুল ও বাড়াবাড়ির কারণে দ্বিগুণ পেছনে পড়ে যাই- এ যেন তৈলাক্ত বাঁশ ও বানরের অঙ্ক করা।
আমরা মনে করছি, বিশ্বসম্প্রদায় আমাদের দেখছে না; আমাদের রাজনৈতিক বাড়াবাড়িগুলো সম্পর্কে তাদের কোনো পর্যবেক্ষণ নেই। হেফাজতের ওপর চড়াও হয়ে আমরা ভেবেছি- মৌলবাদের আঁতুড়ঘরে ছোঁ মারা হলো। কওমি মাদরাসাকে ‘জঙ্গি প্রজননকেন্দ্র’ বানিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের বাহবা পাওয়া যাবে। জঙ্গি ইস্যু খাড়া করে ভেবেছি, ‘বিশ্বসম্প্রদায় বিশেষত পশ্চিমা বিশ্বের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অন্তহীন যুদ্ধে শরিক হলাম। এবার অন্তত পশ্চিমারা আনুকূল্য দেখাবে।’ অথচ পশ্চিমারা কূটনৈতিক ভরসা দেয়। বাস্তবে কিছুই করে না। মুসলিম বিশ্ব যে বার্তা পেল- সেটা ভরসার নয়, হতাশার। এক দিকে আমরা জাতিকে একটি গ্রহণযোগ্য সরকার থেকে বঞ্চিত করলাম। ভোটের অধিকার থেকে জনগণকে বঞ্চিত করলাম। আগে উন্নয়ন, পরে গণতন্ত্র বলে একধরনের দলবাজ সরকার চাপিয়ে দিলাম। এ সরকার জাতিকে অসংখ্য কেলেঙ্কারির সাথে পরিচিত করেছে। প্রথম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন যৌক্তিক। দ্বিতীয় মেয়াদে অভিজ্ঞতার প্রমাণ মিললেও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো তাকে পিছু ছাড়েনি। শেষ মেয়াদে তিনি যুক্তিহীন। পরিস্থিতির ওপর বিশ্বসম্প্রদায় এতটা গভীর পর্যবেক্ষণে গেল- আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিচারবহির্ভূত হত্যার জন্য অভিযুক্ত করা শুরু করল। এলিট ফোর্সের বিলুপ্তি চাইল। আন্তর্জাতিক শান্তিমিশনে আমাদের উপস্থিতির গৌরব ম্লান করে দেয়ার মুখোমুখি হতে হলো। তার পরও আমরা শান্তিতে নোবেল চাইব! কোন ভরসায়? যে দেশের সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলা হয়, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে বিশ্বের তাবৎ মানবাধিকার সংস্থা বক্তব্য দেয়, তথ্য উপস্থাপন করে; সেই দেশের নীতিনির্ধারক শান্তির জন্য পুরস্কৃত হবেন- এটা আশা করতে পারি, বাস্তবে কতটা ছুঁয়ে দেখব, সে ব্যাপারে সংশয় থেকেই যায়।

 

 

Source Link: https://goo.gl/X6vh0C

Source: The Daily Nayadiganta

Updated Date: 9th March, 2017

Related Publications

Yunus Social Business Week launched in China...

Published Date: 15th October, 2015

Grameen China to set up branch in Shenzhen ...

Published Date: 16th October, 2015